spot_img
Home বিশ্ব উত্তর আমেরিকা সায়গন সিটিঃ আমেরিকার যুদ্ধে পরাজয়ের করুন ইতিহাস

সায়গন সিটিঃ আমেরিকার যুদ্ধে পরাজয়ের করুন ইতিহাস

সায়গন সিটিঃ আমেরিকার যুদ্ধে পরাজয়ের করুন ইতিহাস

 

সায়গন-
যুদ্ধের ইতিহাসে আমেরিকার
সবচেয়ে করুন পরাজয়ের গল্প ….

১৯৭৫ সালের ৩০শে এপ্রিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। ভিয়েতনামের কমিউনিষ্ট পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র ক্যাডার দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের উপকন্ঠে পৌঁছে গেছে।

যাদের ভেতর বিপুল সংখ্যক দুর্ধর্ষ নারী গেরিলা…

তিন দিক থেকে তারা ঘিরে রেখেছে পুরো নগরী। অবশিষ্ট মার্কিন সেনাদের সায়গন ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলো।

বার বার বার্তা পাঠাচ্ছে ওরা
“তোমরা আমাদের নিশানার মধ্যে, আমরা তোমাদের ঘিরে ফেলেছি
হয় আত্নসমর্পন করো,চলে যাও
নাহলে মৃত্যুর প্রস্ততি নাও….”

ক্যাপ্টেন স্টু হেরিংটন এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারেন ৩০শে এপ্রিলের সেই দিনটির কথা।

“আমরা আর মাত্র ছয়জন সেখানে আছি। যারা তখনো দূতাবাসের দেয়ালগুলো পাহারা দিচ্ছে তাদের সংখ্যা ও বেশি না, চোখে মুখে তাদের মৃত্যু ভয়…..
ছাদের দিকে তাকালাম। একটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, আমারও কি ঐ হেলিকপ্টারে পালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল

সায়গনের মার্কিন দূতাবাসে তখনো বহু মানুষ উদ্ধারের অপেক্ষায়। তাদের ফেলে আমরা পালানোর কথা ভাবছি….

“ভিয়েতনামে যে আমরা কত জীবন অপচয় করেছি,
পুরো ভিয়েতনাম যুদ্ধের মানেটা কি দাঁড়ালো, কি ভীষণ ট্রাজিক এবং দুঃখজনক পুরো ব্যাপারটা, একেবারে শেষ মূহুর্তে সেই চিন্তা করছিলাম আমরা।”

ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমিউনিষ্ট বাহিনীর হাতে মার্কিন বাহিনী যে পরাজিত হতে যাচ্ছে, সেটা এর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বুঝতে পারছিলেন, ক্যাপ্টেন স্টু হেরিংটন।

কমিউনিষ্ট বাহিনী তখন সায়গনের কয়েক কিলোমিটার এর মধ্যে।
অস্থিরতা বাড়ছে ..

যেসব ভিয়েতনামী মার্কিনীদের সহায়তা করেছে, কমিউনিষ্টদের নির্মম প্রতিশোধ এর শিকার হবে এরা- এটা নিয়ে আমি চিন্তিত।
কিন্তু দুতাবাসের কর্মকর্তারা এদের কথা ভাবছেন না।

স্টু হেরিংটন এবং সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা এদের ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন:

“সেসময় ওখানে আমাদের রাষ্ট্রদূত গ্রেয়াম মার্টিন। তিনিও তখন পর্যন্ত ঘটনার গুরুত্ব আর লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন মোটেই বুঝতে পারছিলেন না।

“আমি তখন আমার অধিনায়ককে বললাম, আমাদেরকেই এখন একটা নাটকীয় কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

সায়গন থেকে সবাইকে আকাশপথে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা, তার সাংকেতিক নাম দেয়া হয়েছিল অপারেশন ফ্রিকোয়েন্ট উইন্ড। পেন্টাগন থেকে শেষ পর্যন্ত এই সংকেত এলো ২৯শে এপ্রিল বিকেলবেলা।

“দূতাবাসের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়লো, প্রচুর লোক। পুরো কম্পাউন্ড জুড়ে গিজ গিজ করছে। প্রায় আড়াই হাজার মানুষ, এদের বেশিরভাগই ভিয়েতনামী।”
চরম বিশৃঙ্খলা….

মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস মিডওয়ে ভিয়েতনামের উপকুলের দিকে ছুটছে। তবে এই জাহাজে বহন করা হচ্ছে অনেকগুলো হেলিকপ্টার। নৌবাহিনীর অফিসার ভার্ণ জাম্পার ছিলেন সেই জাহাজে।

“আমেরিকার বিমানবাহী জাহাজ ‘ইউএসএস মিডওয়ে’ থেকে যত হেলিকপ্টার উঠছিল আর নামছিল, সেগুলোর দায়িত্বে ছিলাম আমি। ‌আমিই ছিলাম এই পুরো অপারেশনের কর্তা।”

সায়গন বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই উদ্ধার অভিযানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প নেই।

“আমাদের এয়াফোর্স ক্রুদের বললাম, তারা কেবল দিনের বেলাতেই বিমান নিয়ে উড়তে পারবে। রাতে বিমান চালানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নিয়ম আমাদের ভাঙ্গতে হয়েছিল। সুর্যাস্তের পর সারারাত ধরে এসব বিমানে লোক আনা হয়েছে।”

“পার্কিং এরিয়াটা রাতে অন্ধকার থাকতো। তাই আমরা রাতে সেটার চারপাশে বৃত্তাকারে গাড়ীগুলো পার্ক করতাম। যখন হেলিকপ্টার সেখানে নামতে আসতো, তখন আমরা গাড়ীগুলোর হেডলাইট অন করে জায়গাটা আলোকিত করতাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেল। তখন আমরা দূতাবাসের ছাদে একটা স্লাইড প্রজেক্টার বসিয়ে সেটা চালু করলাম।

বহু রকম অভিনব কৌশল নিতে হয়েছে।”

“এত বেশি হেলিকপ্টার যাওয়া আসা করছিল যে, আমরা সেগুলো নামতে দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম।

ইউএসএস মিডওয়ে যখন এরকম পালিয়ে আসা মানুষে পরিপূর্ণ, তখন সেখানে হেলিকপ্টার অবতরণের মতো ফাঁকা জায়গা খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়লো। জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে, এমন কিছু হেলিকপ্টার তাদের সমূদ্র ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।

“অনেক হেলিকপ্টার আমাদের জাহাজ থেকে ঠেলে সমূদ্রে ফেলে দিতে হয়েছে। এর মধ্যে একটা ছিল চিনুক হেলিকপ্টার। যত হেলিকপ্টার আমরা সাগরে ফেলে দিয়েছিলাম, তার মূল্য হবে আনুমানিক সত্তর লাখ ডলার।

৩০শে এপ্রিল ভোরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে এক নতুন নির্দেশ এসে পৌঁছালো। মার্কিন মেরিন কমান্ডোদের বলা হলো, ভিয়েতনামী সহকর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা বাদ দিয়ে তাদের এখন প্রত্যেক মার্কিন নাগরিককে নিয়ে সায়গন ছাড়তে হবে। মার্কিন দূতাবাসে তখনো ৪২০ জন ভিয়েতনামী উদ্ধারের অপেক্ষায়। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্টু হেরিংটন সবাইকে ফেলে রওনা হলেন ছাদে অপেক্ষমান এক হেলিকপ্টারের দিকে:

” একটা অজুহাত খুঁজে বের করলাম। বললাম, আমাকে প্রস্রাব করতে যেতে হবে। দূতাবাস ভবনের ভেতরে ঢুকে ছাদে উঠলাম। সেখানে একটি হেলিকপ্টার ছিল। সেই হেলিকপ্টারেও ৫০ জনের মতো ভিয়েতনামীর জায়গা হতে পারতো। কিন্তু ভোর সাড়ে পাঁচটায় এটি আকাশে উড়লো আমি সহ পাঁচজনকে নিয়ে। তখনো ৪২০ জন ভিয়েতনামী দূতাবাসে উদ্ধারের অপেক্ষায় আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক কূটনীতিকও সেখানে আছেন। এরা সবাই পার্কিং লটে অপেক্ষা করছে। কিন্তু তাদের রেখেই প্রায় শূন্য এক হেলিকপ্টারে আমরা সেখান থেকে চলে এলাম।”

বহু ভিয়েতনামী সহকর্মীদের বিপদের মুখে ফেলে পালালাম…..

কথা দিয়েছিলাম, সবার ব্যবস্থা করে দূতাবাস ছাড়বো। সারারাত ধরে বহুবার তাদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই কথা আমরা রাখিনি।”

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ঐ শেষ কয়েকদিনে সাত হাজারের বেশি মানুষকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়েছিল সায়গন থেকে।

সায়গনের মার্কিন দূতাবাস কম্পাউন্ড থেকে শেষ মার্কিন হেলিকপ্টার আকাশে উড়ার কয়েকঘন্টার মধ্যে সেটি দখল করে নিল কমিউনিষ্ট বাহিনী।

সেদিনই কমিউনিষ্টরা সায়গন দখল করে তাদের বিজয় পতাকা উড়ালো আর শহরটির নাম দিল হো চি মিন সিটি…..

আমেরিকার ইতিহাসে শোচনীয় পরাজয় এটা…..

(বিবিসির একটা প্রতিবেদন অবলম্বনে, এএফপির ছবি- হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য দুতাবাসের ছাদে লাইন,)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here