
এমন স্বল্প সময়ে একটি সংগ্রামী জাতির ২৩ বছরের রক্ত দেয়ার কথা, বঞ্চনার কথা, সংগ্রামের চুড়ান্ত অর্জনের জন্য আরও ত্যাগের জন্য জণগণকে উজ্জীবিত করা – এটা শেখ মুজিবের ৭ মার্চের বক্তৃতায় ছিলো। কবি নির্মেলেন্দু গুণ তার বক্তৃতাকে কবিতার সাথে তুলনা করেছেন। তাকে উপাধি দিয়েছেন অমর কাব্যের কবি হিসেবে।
০৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো বাঙালির সমাবেশ। ততদিনে পাকিস্তান মরে গেছে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। শেখ মুজিব কিংবা তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না এই চিন্তা পরিবর্তনের। জণগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তারা আর পাকিস্তানের সাথে থাকবে না।
আর পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জণগণ এতোটাই মরিয়া যে তারা পাকিস্তানের শাসন যন্ত্রের কোন আদেশ মানতেই নারাজ। প্রত্যেক জাতির রাস্ট্র গঠনের একজন নেতা সৃষ্টি হয়। সেই নেতা নিজগুনেই নেতা হিসেবে জণগণের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়। সেই নেতার জণগণের ম্যান্ডেট এর জন্য ভোটের বাইরেও একটি অর্জন থাকে সেটি হচ্ছে জণগণের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়া। হাজার বছরের বাঙালী শেখ মুজিবকে যতটা উজার করে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবও বাঙালীকে ততটাই তার জীবনের সবটাই দিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালী শেখ মুজিবকে বিশ্বাস করেছিল। আর এই বিশ্বাস এতোটাই তীব্র ছিলো যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া তরুণ তরুণীর নিকট শেখ মুজিব নামটি ছিলো প্রেরণা।
০৭ মার্চের বক্তৃতায় শেখ মুজিব দলীয় বৃত্তের ভেতরে নিজের বন্দী করে রাখেনি। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি বক্তব্য করেননি। তিনি গোটা জাতির হয়ে কথা বলেছেন, দিয়েছেন ঘোষণা। মুলত এই দিনেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো ছিলো শুধুমাত্র যুদ্ধ এবং লড়াইয়ের অপেক্ষা। জণগণকে মুক্তির বাণী তিনি উপস্থাপন করেছেন সহজ সরল সাবলীল ভাষায় তাতে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালী জাতির ভাষা বুঝতেন।
০৭ মার্চের এই বক্তৃতা কালজয়ী ভাষণে রূপ নিয়েছে। ০৭ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দিবসটি পালনে রাস্ট্রীয় বাধ্যবাকতা কিংবা আড়ম্বরতার প্রয়োজন আজও হয়নি। ০৭ মার্চ দিনটি জণগণের মুক্তিসংগ্রামের নিজের দিন হয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে।
সেই ভাষণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা “– এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ‘। শেখ মুজিব জাতির পিতা হয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করলেও জণগণের মুক্তি সংগ্রাম সফলতা অর্জন করতে পারেনি। এর মুল এবং প্রধান কারণ তার দলটি নানামুখী ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
তার একক নেতৃত্বকে চ্যালেন্জ করে তারদলেরই এক গুরুত্বপূর্ণ তরুণ নেতা, যাকে মুজিবের ভাবশিষ্য মনে করা হতো তিনি গঠন করেছিলেন জাসদ ও পরবর্তীতে গণবাহিনী। তার আরেক ভাবশিষ্য এবং আত্মীয় যুবলীগ গঠন করে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন রক্ষীবাহিনী নামক একটি আধা সামরিক বাহিনীর ওপর। যার প্রতি জণগণ ও সেনাবাহিনীর সন্দেহ, অবিশ্বাস ছিলো প্রবল।
নেতাকে রক্ষা করতে হয় তার আদর্শ অনুসরণ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে স্তুতি আর বন্দনার ঘেরাটোপে বন্দী করে তার রাজনৈতিক জীবনকে করেছে ক্ষতিগ্রস্হ। তার দলটি মুসলিম লীগের পেটের ভেতর থেকে জন্ম নেয়া। আর সে কারণেই সেই ভাবধারার ব্যাক্তিবর্গের উপস্থিতিও সেখানে ছিলো শক্তিশালী। ফলে তার কঠোর ও বিপ্লবী সিদ্ধান্তের দিকে যখন অগ্রসর হয়ে চলা ঠিক সেই মুহূর্তেই শেখ মুজিব বিপন্ন। বড় একাকী এবং প্রতিবাদহীন বাংলাদেশে খুন হয়ে ঢাকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে নিজগৃহে লাশ হয়ে পড়ে থাকা।
জণগণ মুজিবকে যতটা বাঁচিয়ে রেখেছে ততটাই নিঃশেষিত করতে চেয়েছে তারদল আওয়ামী লীগ। হাতে গোণা দু কি তিনজন বাদে তার সকল মন্ত্রীসভার সদস্য সেইদিনই মন্ত্রী থেকেছেন। রেডিও টেলিভিশনে দেয়া ” স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ” এই ঘোষণার সমর্থনে কেউ কথা বলেছেন, কেউ নিরব থেকে দিয়েছেন সমর্থন।
আজকে যে মুজিব বন্দনা সেটিও মুজিব আদর্শের জন্য না। যদি মুজিব স্ব মহিমায় শুধুমাত্র ০৭ মার্চের ভাষণকে সম্বল করে ইতিহাসে ফিরে না আসতে পারতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ তাকে আশ্রয় দিতেন না। রাজনীতিতে জণগণের মুক্তি বিশেষ করে অর্থনৈতিক মুক্তির বিপরীতে চলা আওয়ামী লীগ মুজিবকে ভয় পায়। তাকে আশ্রয় এবং পুঁজি করেই চলতি চায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশ নামক রাস্ট্রটিই যথেষ্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটি টিকে থাকার জন্য মুজিবই একমাত্র ভরসা।
০৭ মার্চ ১৯৭১ এর দিনটিকে আমরা শুধুমাত্র মুজিবকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করি না, স্মরণ করি সেই সময়ের লাখো লাখো জনতা যারা রেসকোর্সে উপস্থিত হয়ে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে মুক্তি সংগ্রামকে করেছিলো অনিবার্য।
লেখক
রুস্তম আলী খোকন
কলামিস্ট, রাজনীতি বিশ্লেষক
সম্পাদক, নিউজ টাইমস ২৪