spot_img
Home বিশ্ব আমেরিকা কি সত্যি সত্যি হাত গুটাচ্ছে?

আমেরিকা কি সত্যি সত্যি হাত গুটাচ্ছে?

আমেরিকা কি সত্যি সত্যি হাত গুটাচ্ছে?

জো বাইডেন কি পরোক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ সমাপ্তি ঘোষণা করলেন?

আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধে নিদারুণ পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে। অর্থাৎ বিশ্বে স্বীয় আধিপত্য বহাল রাখার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গত কয়েক দশকে অনুসৃত তার কর্মকৌশলে বড় ধরনের রদবদল ঘটাবে বলেই এখন অনুমান করা হচ্ছে।
আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত‍্যাহার শেষ হবার পর ৩১ আগস্ট প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে ভাষণ দেন সেখান থেকেই এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
বাইডেন তার ভাষণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বদলের ঘোষণা দিয়ে বলেন, অন্য দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য পাঠিয়ে ‘জাতি গঠনের’ দায়িত্ব নেবার যুগের অবসান হয়েছে। তিনি বলেন, যেসমস্ত জঙ্গি গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে তাদের লক্ষ্য করে ওয়াশিংটনের হামলা অব‍্যাহত থাকবে, কিন্তু যেসব দেশে কখনোই গণতন্ত্র ছিল না সেসকল স্থানে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আর মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানো হবেনা। “বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পরিবর্তনের এটাই সময়। এ সিদ্ধান্ত শুধু আফগানিস্তান নিয়েই নয়, এটা একই সঙ্গে অন‍্য দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর যুগেরও সমাপ্তি বটে,” বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই ঘোষণার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, নাইন-ইলেভেনে নিউইয়র্কে পরিচালিত সন্ত্রাসী হামলার ছুতো ধরে যুক্তরাষ্ট্র, প্রথমে আফগানিস্তান আক্রমণ করার মাধ্যমে, দুই দশকব‍্যাপী যে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সূচনা করেছিল কার্যত তার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। বেশ কিছু দিন ধরেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মহলে এরকম চিন্তাভাবনা চলছিল, তবে তাদের মধ্যে এনিয়ে মতপার্থক‍্যও ছিল। অবশেষে, আফগানিস্তানে পরাজিত হয়ে, ট্রাম্পের করা চুক্তির ভিত্তিতে, জো বাইডেন এই ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-এর প্রক্রিয়ার ইতি টানলেন।
বলা বাহুল্য যে যুক্তরাষ্ট্রের এই কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আসল লক্ষ্য কোনো সন্ত্রাস নির্মূল করা ছিল না, বরং দেশে দেশে তাদের এই প্রত‍্যক্ষ‍ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে নতুন করে বিরাট সন্ত্রাসের দাবানল প্রজ্জ্বলিত হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যে বিরাট পরিবর্তন আসে এবং যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়। এর সুযোগ নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মধ‍্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ‍্য ও উত্তর আফ্রিকায় সরাসরি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের দৃষ্টিতে সেখানকার ‘দুর্বৃত্ত’ রাষ্ট্রগুলোকে উচ্ছেদের মাধ্যমে কতগুলো তাবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন ওই অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেছিল, একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালাও ছিল তদ্রূপ। আফগানিস্তান হচ্ছে মধ‍্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার। বিরাট ভূকৌশলগত গুরুত্বের পাশাপাশি এই মধ‍্য এশিয়ায় রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল-গ‍্যাসের ভান্ডার। সুতরাং মধ্য এশিয়া ও মধ‍্যপ্রাচ‍্যে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, এটাই ছিল তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওই ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রধান কারণ। ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের মাধ্যমে এর সূত্রপাত হলেও ২০০১ এ জর্জ ডাব্লিউ বুশের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধের ঘোষণা ও আফগানিস্তান আক্রমণ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের এই উপনিবেশ বিস্তারের লড়াই। অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদর এই স্বঘোষিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছিল আসলে, বিশ্বের এক বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে নতুন করে তার উপনিবেশ হিসেবে পদানত করার মহাপরিকল্পনার অংশ! ‘সন্ত্রাস দমন’, ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’, ‘নারীর অধিকার’ প্রতিষ্ঠা তথা ‘জাতি গঠন’ ইত্যাদি ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে এই আগ্রাসন চালানো হলেও আফগানিস্তান ও আরব বিশ্বের জনগণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে সাম্রাজ্যবাদী দস‍্যুদের এই ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব কায়েমের পরিকল্পনা শেষমেশ ভন্ডুল হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে এক ‘অন্তহীন যুদ্ধের চোরাবালিতে’ আটকে গেলেও, ওই দুই দশক সময়ে চীন প্রভূত অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করে মার্কিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকব‍্যাপী ঔপনিবেশিক যুদ্ধ কার্যত তার জন্য বুমেরাং হয়ে এসেছে।
আর প্রধানত সেই কারণেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৩১ আগস্ট তারিখে তার ভাষণে প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এবং আফগানিস্তানের পাশাপাশি এখন ইরাক ও সিরিয়া থেকেও মার্কিন সেনা প্রত‍্যাহারের তোড়জোড় চলছে বলে জানা গেছে। অবশ্য প্রয়োজন হলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সার্থবিরোধী সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ‍্যা দিয়ে তাদের ওপরে মার্কিন বাহিনীর ড্রোন হামলা, ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ, বোমাবর্ষণের পাশাপাশি কমান্ডো হামলা, প্রক্সি যুদ্ধ ইত্যাদি অব‍্যাহত থাকবে। তবে আপাতত আর ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো সরাসরি স্থল বাহিনী পাঠিয়ে ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পথে হাটবেনা তারা।
ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার পরিবর্তনের ফলে মধ্য এশিয়া ও মধ‍্য প্রাচ‍্য ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি চীনকে মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন মধ‍্য প্রাচ‍্যে আর শক্তি ক্ষয় না করে তার মনোযোগ সরিয়ে এনে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় কেন্দ্রীভূত করছে। উল্লেখ্য, ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক কৌশলগত নীতিমালা পুনর্বিনস্ত করে। পেন্টাগন তখন ঘোষণা করে, ” সন্ত্রাসবাদ নয় বরং বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হচ্ছে এখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।” বতর্মানে এই লক্ষ্যেই তারা চীনবিরোধী এক নতুন শীতল যুদ্ধের সূচনা করেছে। ফলে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব এখন বিশ্ব রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন আরও বড়ো ধরনের যুদ্ধ বাঁধাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

## Omar Rabbee.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here